পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কারণে নানা সমস্যায় পড়ছে স্থানীয়রা। এ ছাড়া এই উদ্যোগের ফলে পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও দালাল চক্রের খপ্পরেও পড়ছে তারা। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সেখানে কি ধরনের প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে প্রাথমিক এক গবেষণায় এসব কথা জানানো হয়।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ যৌথভাবে ‘নির্মাণাধীন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্প: একটি আর্থসামাজিক সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় অংশগ্রহণ করা ৯৩ শতাংশ জানিয়েছেন, উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারীদের সবাই জানিয়েছেন, এই নির্মাণকাজের কারণে গাছপালার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যার কারণে সেই এলাকার তরমুজ, পালং শাক এবং অন্যান্য শাকসবজি পচে এবং কালো হয়ে যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আশিকুর রহমান। পরিকল্পিত আশুগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্পর্কে স্থানীয় নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনা শনাক্ত করার জন্য একটি সত্য অনুসন্ধান মিশনের অংশ হিসাবে এই সংক্ষিপ্ত গবেষণাটি করা হয়েছিল। মোট ১০০টি সাক্ষাৎকার থেকে কিছু গুরুতর উদ্বেগ ও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়নি। ২০২২ সালের এপ্রিলে বালি ভরাটের কার্যক্রম শুরু হয়। ক্ষতিপূরণ ছিল সর্বনিম্ন ৬০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ লাখ টাকা। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১০০ জন উত্তরদাতাদের মধ্যে সর্বাধিক ৮৪ শতাংশ উত্তর দিয়েছেন যে আনুমানিক পরিমাণ প্রকৃত নয়। তাদের মধ্যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দাবি করেছে স্থানীয় দালাল অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের অতিরিক্ত মূল্য দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
আশিকুর রহমান বলেন, ‘মোট পুনর্বাসনের জন্য তারা ভূমি অধিগ্রহণ অফিস, ভূমি জরিপকারী এবং ভূমি অধিগ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য খাতে ঘুষ হিসাবে দালালকে সর্বনিম্ন ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রদান করেছে।’
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সবাই জানিয়েছেন, এই উদ্যোগের ফলে গাছপালার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যার মধ্যে সেই এলাকার তরমুজ, পালং শাক এবং অন্যান্য শাকসবজি পচে এবং কালো হয়ে যাবে। মাঠ পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, আশপাশের মাটির স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ও অবনতি ঘটছে। মাটির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্নে মোট ৮২ শতাংশ এই নির্মাণকাজের কারণে মাটির দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া ৭৯ শতাংশ বায়ুর মানের অবনতির জন্য উদ্বেগের সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন।
উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বিগ্নের কথা জানিয়ে আশিকুর রহমান বলেন, ৯৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের ক্রমবর্ধমান উত্তর এবং মিডিয়া রিপোর্ট থেকে আরও দেখা গেছে, ওই এলাকার মানুষ বঙ্গোপসাগর থেকে তীব্র আবহাওয়ার ধরণ, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ব্যাপক ভাঙন, ডলফিন ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু এবং সেই সঙ্গে পরিবর্তিত অভিবাসন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। নিকটবর্তী এলাকায় ইলিশ সম্পদের রুট।
জনসাধারণের ধারণা, প্রকল্পটি শেষ হলে জলযানের ঘনঘন চলাচল এবং দূষণ বৃদ্ধির কারণে ওই এলাকা থেকে মাছ ধরা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। গবেষণার অংশ নেওয়া সবাই বলেছেন, শিল্পায়নের কারণে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে পাবে।
মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন বলেন, প্রকল্পের নির্মাণের কারণে অংশগ্রহণকারীদের আশঙ্কা করছেন মাছ অনেক দূরে চলে যাবে, তাই তাদেরকে তাদের জীবিকা পরিবর্তন করতে হবে। ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় নদীতে মাছ ধরা সম্ভব নয় এবং তাদের জীবিকা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
নির্মাণকাজের সাংস্কৃতিক প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা সম্পর্কে উত্তর দিয়েছেন। উত্তরদাতারাও সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। সমীক্ষায় ৭৯ শতাংশ জানিয়েছে এই প্রকল্প নির্মাণের কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ আক্রমণ করতে পারে এবং ৬৯ শতাংশ উত্তরদাতারা প্রকল্পের কারণে সম্ভাব্য গুরুতর শব্দ দূষণ সমস্যা হবে বলে মত দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে বাপা এর যুগ্ম সম্পাদক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘বিদ্যুৎ প্রকল্প কোথাও হলে সেখানের মানুষই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিষয়টি তা নয়। আপনার ছেলে যদি ধানমন্ডি পড়েও সে কিন্তু এটা দ্বারা আক্রান্ত হবে। পটুয়াখালী হলে সিলেটের মানুষও কিন্তু আক্রান্ত হবে। বাতাসের গতিবেগের কারণে এটা কিন্তু চলে আসবে। বায়ু দূষণ এখন ঢাকা না উপকূল অঞ্চলেও এটা ছড়িয়ে পড়েছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘ইলিশ মাছের সাইজ ছোট হয়ে যাচ্ছে। তারপর প্রজননের পথ পরিবর্তন করে ফেলছে। এটার মূল কারণই হল সেখানকার পরিবেশ দূষণের ফলে বাস্তুসংস্থানের যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সেটার কারণেই হচ্ছে।’
ভুক্তভোগী এক কৃষক ফরিদ তালুকদার বলেন, ‘আমাদের এখানের অধিকাংশই তিন ফসলি জমি। প্রকল্পে যত জমি প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ বিশেষজ্ঞেরা বলেছে কৃষি জমিতে কোনো বিদ্যুৎ নয়। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিবিদরা বলে একটা, চামচারা করে আরেকটা। কিছু বললে তারা করে মামলা। আর বলে সরকারি প্রজেক্ট। স্বাস্থ্যগত সমস্যা জমির ন্যায্য মূল্য না পাওয়াসহ আমরা নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছি।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে বাপার যুগ্ম সম্পাদক ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমীন মুরশিদ, বাপার যুগ্ম সম্পাদক ও বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়ক মিহির বিশ্বাস, বাপার নির্বাহী সদস্য ও অর্থ, বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কমিটির সদস্যসচিব এম এস সিদ্দিকী, বাপার নির্বাহী সদস্য ও নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।